জোরালো প্রতিবাদেও উদাসীন সুর-অপরাধী!
এআর রহমানকে ঘিরে সমালোচনার ঝড়। স্পষ্টত নিন্দিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দক্ষিণী সঙ্গীতজ্ঞ। তোলপাড় সামাজিক মাধ্যম। তার বাইরেও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন অনেকে। ঘটনার কেন্দ্রে নজরুলগীতি—কারার ঐ লৌহ কপাট।
১০ নভেম্বর, শুক্রবার, ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে পরিচালক রাজা মেননের (Raja Menon) হিন্দি চলচ্চিত্র ‘পিপ্পা’ (Pippa)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতের ভূমিকাকে বিষয় করে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন এআর রহমান (AR Rahman)। সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধের টালমাটাল সময়কে ধরতে চেয়ে পূর্বোক্ত নজরুলগীতির রিমেক করেছেন তিনি। এবং গোল বাঁধিয়েছেন বিস্তর।
![](https://amritabazar.in/wp-content/uploads/2023/11/Nazrul-Islam.jpg)
প্রথমত, পরাধীন ভারতবর্ষে আগুন ঝরানো সময়ের যন্ত্রণা ও আকাঙ্ক্ষা ধরা রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটিতে। গত শতাব্দীর ২-এর দশকে এই গান কতটা অনুপ্রেরণা এবং একই সঙ্গে কতখানি ক্লেশের কারণ হয়েছিল, তা বোঝার জন্য ইতিহাসের গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। অথচ সেই অপরিসীম গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতাটাই টের পেলেন না রহমানের মতো অত বড় মাপের মিউজিশিয়ান! ব্যাপার সত্যিই বিস্ময়কর।
দ্বিতীয়ত, কাজী নজরুল ইসলাম চেন্নাইয়ের পাড়ায় এআর রহমানের কোনও আড্ডাসঙ্গী নন। রহমান তাঁর অস্কার ধুয়ে জল খান, আপত্তি নেই; কেবল এটুকু মনে রাখলে পারতেন যে, বিশ্বখ্যাতির তোয়াক্কা না করা ‘খ্যাপা ধূমকেতু’ নজরুলের পায়ের কাছে বসবার যোগ্যতা আজও প্রাচ্য সঙ্গীত জগতে একটা অর্জনের বিষয়। রিমেক করতে গিয়ে কবির প্রকৃত সুর ছেঁটে ফেলার এই ‘বেয়াদবি’ বরদাস্ত করা কঠিন। আসলে ঔদ্ধত্যে অন্ধ হয়ে সঙ্গীতের প্রতিই চূড়ান্ত অবিচার করে বসেছেন এআর রহমান। এ যেন স্বয়ং সুরের দেবীর অঙ্গহানি! রহমান দু’দিনের সাধক নন। তাঁর বুকে এই ব্যথা বাজল না, একে ‘মায়ার খেলা’ ছাড়া আর কী বলা যায়!
তৃতীয়ত, রহমানকৃত সুর ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতাকে ধরল কতটুকু? এ তো ঘুম-ভাঙানিয়া উদ্দীপনার জায়গায় ঘুম-পাড়ানিয়া নিস্তেজনা হয়ে গেল! এপার, ওপার—পদ্মার দু’দিকের চেতনা নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার কে দিল আল্লা রাখা রহমানকে? নাকি বাংলা বলেই এতটা উদাসীনতা দেখানোর সাহস পেলেন দক্ষিণী তারকা? অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রশ্নগুলো কিন্তু নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছে সাম্প্রতিক রহমানীয় কারবারে।
চতুর্থত, বঙ্গের একাধিক গায়ক এআর রহমানের সুরারোপিত রিমেকে গলা দিয়েছেন। তাঁরা কি নজরুলগীতিটি সম্পর্কে অজ্ঞ? অথবা, কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে কোনও এক রহমান তাঁদের চোখে মহত্তর ও বৃহত্তর স্রষ্টা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন? ঘটনা যাই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই লজ্জা রাখার জায়গা নেই। বাঙালির মুখ পোড়ানোর জন্য আসলে বাঙালিই যথেষ্ট, প্রাচীন প্রবাদ।
পঞ্চমত, কাজী নজরুলের উত্তরাধিকারী সূত্রে সংবাদ এই যে, ২০২১-এ কবির পুত্রবধূ তথা বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী কল্যাণী কাজীর থেকে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’-এর রিক্রিয়েশন সংক্রান্ত অনুমতি পান এআর রহমান। সেক্ষেত্রে শর্ত ছিল, ‘কথা ও সুর অবিকৃত রাখার এবং পুনর্নির্মিত গান প্রকাশের আগে শুনিয়ে নেওয়ার।’ প্রশ্ন হল, এ বিষয়ে আইনি কাগজপত্র তৈরি হয়েছিল কি? আমরা জানি না। সুভদ্র সৌজন্যাচার সকলের প্রাপ্য নয়। ‘বন্দে মাতরম’-এর ছ্যাবলা-বিকৃতি-খ্যাত এআর রহমানের তো নয়ই। সেই সচেতন বিবেচনায় যদি কাগজপত্র তৈরি হয়ে থাকে (কল্যাণী কাজীর প্রয়াণ কোনও আইনি অন্তরায় নয়), তাহলে অবিলম্বে কাজী অনির্বাণরা আদালতের দ্বারস্থ হবেন আশা করি। সেটাই এখন বাংলার অনুভবের প্রতি সবচেয়ে বড় সুবিচার।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিশিষ্টরা সঙ্গত কারণেই সরব হয়েছেন এআর রহমানের বিরুদ্ধে। আবার এরই ফাঁকফোকরে গজিয়ে উঠেছে ভিন্ন সুর। তা গজাক। কণ্ঠরোধের অগণতান্ত্রিকতা কোনও ভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে রহমানের পাশে দাঁড়ানোর পিছনে কী যুক্তি দিচ্ছেন তাঁরা? বাংলাদেশের এক প্রাবন্ধিক বিশেষজ্ঞ সহ কতিপয় পণ্ডিতের দাবি—
সুর ও কথা নিয়ে এই পরীক্ষানিরীক্ষায় এত শোরগোল ফেলার কিছু হয়নি! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এসব করেছেন। সফল হোক বা ব্যর্থ—সৃষ্টির শর্তই হল এক্সপেরিমেন্ট। এর বিরুদ্ধে রে-রে করে তেড়ে যাওয়া ‘প্রকৃত প্রস্তাবে’ একধরনের মৌলবাদ!
মুশকিল হল, এই সকল বিশেষজ্ঞরা অনেকগুলো বিষয় বোঝেন না, এবং তাই গুলিয়ে ফেলেন। আমাদের দেশে, জটিল ও দুর্বল হলেও, কপিরাইট বলে একটা আইন আছে। এঁরা জানেন না। সেটা লঙ্ঘন করলে, তিনি যে-ই হন, আদালতের চোখে অপরাধী। সৃজনশীলতার দোহাই দিয়ে শিল্পেই স্বেচ্ছাচার করাটা শিল্পীসুলভ বিষয় নয়। এঁরা সে’কথায় আমল দেন না। রবীন্দ্রনাথের ‘স্বীকরণ’ (আত্তীকরণ) আর রহমানের ‘বিশ্রীকরণ’ (বিরোধী-অনুরাগী নির্বিশেষে কারও শ্রবণেন্দ্রিয়ই সুখানুভূতির শিকার হয়েছে বলে খবর নেই!)—এক জিনিস নয়। এঁরা অন্ধ থাকেন। রিমেক (remake) আর অ্যাডপটেশন (adaptation) অর্থগতভাবে ও প্রয়োগ-প্রকরণে সম্পূর্ণ আলাদা, ভিন্ন শর্তে গ্রহণীয়। এঁরা গুলিয়ে ফেলেন। এইসব নবোদ্গত গণতন্ত্র-পূজারীরা জানেন কি, খোদ এআর রহমানই তাঁর নিজের গানের উপর অন্য কেউ পরীক্ষানিরীক্ষা করায় যথেষ্ট অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন অতীতে? কিছুই না জেনেবুঝে, কেবল অন্যরকম মত প্রকাশের তাড়নাও একধরনের বিকৃতি। গণতান্ত্রিক পরমতসহিষ্ণুতার সঙ্গে তার সম্পর্ক মোটে ঘনিষ্ঠ নয়। প্রতিবাদমাত্রই মৌলবাদ হলে, আত্মমর্যাদাবোধের ‘হাতে রইল পেন্সিল’ দশা হয়ে যায়—মনে রাখলে ভালো, না মনে রাখলেও ক্ষতি নেই। কেননা সেক্ষেত্রে উপেক্ষার অতিরিক্ত কিছু জুটবে না।
©Dani Charles Silverscreen Media Inc.|’AR Rahman‘|CC BY-SA 3.0|cover image