বিচ্ছিন্নতার মূলে বিপদের ডঙ্কা!

মনের ঘরে দোর দেওয়ার আগে ভেবে দেখুন…

ভারতকে তুলনাহীন বলে উল্লেখ করলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় (CJI DY Chandrachud)। কারণ হিসেবে তিনি এদেশের যৌক্তিক সংলাপপ্রবণতাকে সমূহ কৃতিত্ব দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির ব্যাখ্যা, ‘অন্যান্য জাতি যখন আইনের শাসনের উপর হিংসা ও বন্দুকের ক্ষমতাকে স্থান দিয়েছে, তখনও ভারত গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছে। এবং তা সম্ভব হয়েছে সংলাপ (‘reasoned dialogue’) জারি রাখার প্রতি আমাদের সক্ষমতার জেরে। ভারতীয় সংস্কৃতি স্বরূপত যৌক্তিক সংলাপের সংস্কৃতি।’

তবে দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির শুক্রবারের বক্তব্য পুরোটাই নিটোল ভারতবন্দনা নয়। বরং আলোচনার দরজা সর্বদা খোলা রাখার উদার ভারতীয় সংস্কৃতিকে ঘিরে তাঁর উদ্বেগই প্রধান এক্ষেত্রে। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বায়ন-উত্তর মানচিত্রে বাম-দক্ষিণ ও মধ্যপন্থীদের ভিতর যে মেরুকরণ (polarization) আমরা প্রত্যক্ষ করছি, ভারতও আজ তার ব্যতিক্রম নয়। সামাজিক মাধ্যমের রমরমা, সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা, নতুন প্রজন্মের ক্ষণস্থায়ী মনোযোগ সেই মেরুকরণকেই চিহ্নিত করে।’

সমাজ ও সম্প্রদায়ে গান্ধীবাদের প্রসার ঘটানোয় বিশেষ অবদানের জন্য ৪৫ তম জামনালাল পুরস্কার (45th Jamnalal Bajaj Awards) বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘বিশ্বব্যাপী এই মেরুকরণ কেবল মুক্ত অর্থনীতি ও প্রযুক্তির পরিণামে বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘটছে, এমন নয়। এর শিকড় আরও গভীরে। প্রান্তিক মানুষের উন্নত ভবিষ্যৎ রচনাই যেকোনও সম্প্রদায়ের বৃহত্তর উদ্দেশ্য। এবং সেই উদ্দেশ্যে উপনীত হতে হলে আত্মত্যাগ জরুরি। আমাদের সমাজের ভিতরেই যে সেই আত্মত্যাগের শক্তি ও সামর্থ্য নিহিত আছে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে তা আমরা অনুধাবন করতে পারছি না। তাই মেরুকরণের এমন বাড়বাড়ন্ত।’

প্রধান বিচারপতি এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন চারপাশে ঘটে চলা অন্যায়-অবিচারের প্রসঙ্গ। তাঁর বিশ্লেষণাত্মক পরামর্শ, ‘অবিচারের মুখোমুখি হলে আমরা যেন সেটাকে সাময়িক পরিস্থিতি হিসেবে গ্রহণ না করি। আমরা যদি অবিচারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রতিহত না করি, তাহলে ঘোরতর বিপদ ডেকে আনব। সাময়িক পরিস্থিতি হিসেবে অগ্রাহ্য করা অবিচার তখন আমাদের সমাজকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে এবং সম্ভবত গোটা সমাজব্যবস্থাকে ডুবিয়ে ছাড়বে।’

ভারতীয় আইন বিষয়ক সংবাদের অনলাইন পোর্টাল বার অ্যান্ড বেঞ্চ (bar and bench) এই সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম-সংলগ্ন পরিসরে স্থান দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যধৃত অবিচারের প্রসঙ্গকে। নেহা যোশীকৃত (Neha Joshi) প্রতিবেদনটিতে এমত রচনাসজ্জা অমূলক নয়। কারণ, প্রান্তিক মানুষের ভবিষ্যৎ রচনার পথে বড় বাধা হল নিয়ত ঘটে চলা অবিচার, যা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রকট বা প্রচ্ছন্ন অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। ফলত অবিচারের প্রতি আমাদের বর্তমান মনোভাবই প্রধান বিচারপতির বাকি বক্তব্যকে অবধারিত করে তুলছে।

আমরা কি আসন্ন সংকটের কথা মাথায় রেখে, প্রসাদভোগী ক্ষমতার প্রশ্রয়লব্ধ অন্যায়ের বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত বিরুদ্ধতায় উত্তীর্ণ হতে পারব? প্রশ্নটা ভাবনা উদ্রেককারী; কিন্তু তারচেয়েও বেশি ভেবে ফেলার।