বিশ্বজিত ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট সাংবাদিক :
পড়শি রাজ্য ওড়িশায় বিভিন্ন জায়গায় “বাংলাদেশি” সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের মারধর, হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘ দিন ধরে ওই শ্রমিকরা কর্মসূত্রে ওড়িশায় থাকলেও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার পরে তারা নিরাপত্তা হারিয়েছেন। এই রাজ্যের মালদহ, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের কয়েক জন পরিযায়ী শ্রমিককে মারধরের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এদের অনেকেই কটক, বোলাঙ্গির ও ভদ্রক জেলায় মশারি, চাদর, গামছা ও অন্যান্য সামগ্রী দীর্ঘদিন ধরে ফেরি করে সংসার চালিয়ে আসছেন। কয়েক দিন ধরে এরাই নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। বৈধ্য আধার কার্ড, ভোটার কার্ড থাকলেও ছাড় পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ।
ওড়িশায় বঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থায় উদ্বিগ্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি ফোন করেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝিকে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি হবে না বলে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করেন। কিন্তু তারপরেও ঘটনা বলছে অন্য কথা। ওড়িশায় রুটি রুজি হারিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে ফিরে আসছেন রাজ্যে । তাঁদের অভিযোগ “বাংলাদেশী” তকমা দিয়ে তাঁদের মারধর করা হয়েছে। খুনের হুমকি ও দেওয়া হয়েছে। ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় স্থানীয় পুলিশের কাছে গেলে তারা অভিযোগ নেয়নি। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর ওড়িশায় ছিলেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে এক অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব গন অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক আন্দোলনের মাঝে এই গনতান্ত্রিক আকাঙ্খা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে মৌলবাদী ধর্ম মোহের চেনা ধারাও। ফলে গনতান্ত্রিক আশার সঙ্গে আশংকা ও মিশে রয়েছে। প্রতিবেশী দেশের মৌলবাদের বিপদ বাড়লে তা যে এদেশে ও মৌলবাদের হাত শক্ত করে সে তো আমরা অনেক বার দেখেছি। এই বিপদের ছায়ায় সংকীর্ণ রাজনীতিই পুষ্টি পায়। তারই কি পদচিহ্ন দেখা যাচ্ছে বিজেপি শাসিত ওড়িশায়? ওড়িশার ঘটনায় যে প্রশ্ন উঠছে তার হল বিজেপি কে ই ঠিক করতে হবে দলের বিভেদ সৃষ্টির রাজনীতিকে তাঁরা কতদূর নিয়ে যাবেন? মেরুকরণের হাতিয়ার দিয়ে গরিব গায় গতরে খেটে খাওয়া মানুষের রুটি রুজির অধিকার কেড়ে নিতেও কি তাদের আপত্তি নেই?
প্রাচীন কাল থেকেই এই বঙ্গে বিভিন্ন ভাষাভাষীর বাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ও সেই ধারায় ছেদ পড়ে নি। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক রাজনীতির বিপদ বিভিন্ন সময় মাথাচাড়া দিয়েছে। কয়েক দশক আগে মহারাষ্ট্র এই রাজনীতির ভয়ঙ্কর বিপদ দেখেছে। মরাঠা ভূমে এই বিভেদের রাজনীতি থেকেই কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জমি শক্ত হয়েছে। এই রাজনীতির কারণে সে রাজ্যে অন্য রাজ্য থেকে যাওয়া শ্রমিকরা হিংসার শিকার হয়েছেন। গত এক দশকে উত্তরভারতে গৈরিক রাজনীতির দাপটে বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের ভারতবাসীকে নিজ ভূমে পরবাসী করার চেষ্টা প্রবল আকার ধারণ করেছে। এই অশান্তির রাজনীতির মাঝেও পশ্চিমবঙ্গ নিজের সম্প্রীতির ধারা বহন করে চলেছে। এই রাজ্যে অনেক জায়গায় জনবসতির পরিচিতি সেই এলাকায় বসবাসকারি সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্টীর নামানুসারে। সেই হিসেবে একদিকে উত্তর কলকাতা অন্যদিকে খিদিরপুরে বিশেষ একটি জায়গায় ওড়িয়া ভাষীরা সংখ্যায় বেশি থাকায় সেই এলাকার পরিচিতিতেই তার চিহ্ন রয়েছে।অথচ রাজ্যের জনসংখ্যার বিচারে তাঁরা সংখ্যালঘু। কিন্তু পরিচিতির কারণে এই রাজ্যে কোথাও কখনো তাঁদের বিপদে পড়তে হয়নি। বিশেষ কয়েকটি পেশায় সুদীর্ঘকাল থেকেই ওড়িয়া ভাষীরা যুক্ত রয়েছেন এই রাজ্যে। দেশের সুস্থিতি ও সংহতির স্বার্থেই এই বিপজ্জনক খেলা বন্ধ হওয়া জরুরি। সংকীর্ণতম দলীয় স্বার্থের কারণে দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে চাইলে তা দেশকে কালিমালিপ্ত করে।
এই প্রসঙ্গে রাজ্য সভার সাংসদ ও পশ্চিমবঙ্গ migrant workers welfare board য়ের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম বলেন, “সুপরিকল্পিত চক্রান্ত করে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের ওড়িশা থেকে বিতাড়ন করা হচ্ছে। দেশের যেকোনো প্রান্তে আমাদের দেশের যে কোন নাগরিকের ব্যবসা-বাণিজ্য কাজকর্ম করার সমান অধিকার রয়েছে। অথচ বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ফেরিওয়ালাদের বাংলাদেশী তকমা দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। গরিব খেটে খাওয়া মানুষের ওপর সুপরিকল্পিত আক্রমণ মেনে নেওয়া যায় না। এর আগেও রাজস্থান গুজরাটে হয়েছে মুম্বাই হয়েছে ।এবার উড়িষ্যায় বিজেপি সরকার গঠন করার পর একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আমরা পুরো বিষয়টি ওপর নজর রাখছি। আক্রান্তদের সব রকম সাহায্য করা হচ্ছে। আশা করব ওড়িশা সরকার খুব তাড়াতাড়ি আক্রান্ত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াবেন এবং দুষ্কৃতীদের শাস্তি দেবেন। পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ সব রকম সহযোগিতার জন্য সর্বক্ষণ নজর রাখছে”।
