প্রতিবাদ জারি থাক, সঙ্গে অসহায় মানুষদের কথা এবার ভাবুন
এক জুনিয়র ডাক্তারের নৃশংস হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে কলকাতার আর জি কর হাসপাতাল এখন বাংলা ছাড়িয়ে দেশ, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একটানা ৩৬ ঘন্টা ডিউটির মাঝে বহু রোগীর প্রাণ বাঁচিয়ে রোগীর আত্মীয় পরিজনদের মুখে হাঁসি ফুটিয়ে, সহকর্মীদের সঙ্গে প্যারিস অলিম্পিকে হার জিতের লড়াই দেখতে দেখতে রাতের খাওয়া ভাগ করে খাওয়ার পর পাশের সেমিনার রুমে নীল কার্পেটের ওপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ডাক্তার। হাসপাতালের নিরাপত্তা যাদের হাতে সেই রক্ষক সিভিক পুলিশ সঞ্জয় রায় ৩১ বছরের জুনিয়র মহিলা ডাক্তারের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ ও পাশবিক অত্যাচার করে খুন করে।এই নৃশংসতাকে ব্যাখ্যা করার কোন ভাষা নেই।আশঙ্কা করা হচ্ছে এই হত্যার পিছনে শুধুমাত্র হঠকারি যৌন পাশবিকতা লুকিয়ে নেই, এর অন্তরালে জড়িয়ে রয়েছে গভীর থেকে গভীরতর ষড়যন্ত্র।যে ষড়যন্ত্রের মূল ষড়ষন্ত্রী এখনো আড়ালে রয়ে গেছে।
ডিসেম্বরে যে মেয়েটি তাঁর ভালবাসার মানুষ ডাক্তার প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।তাঁর সব স্বপ্ন চিরদিনের মতো স্বপ্নই থেকে গেল।চিরঘুমের দেশে আজ আমাদের অভয়া, আমাদের তিলোত্তমা।
ঘটনার শুরু থেকেই রাজ্য পুলিশ প্রশাসন যে একেবারে হাত গুটিয়ে বসেছিল এমনটা সরাসরি অভিযোগ করা যাবে না। ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলে গেছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল।বিশেষ করে কলকাতা পুলিশের একজন সিভিক ভলেন্টিয়ার এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত হিসাবে ধরা পড়ার পর নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া সিভিক পুলিশের বে আব্রু চেহারাটা ধরা পড়ে। কলকাতা পুলিশের ৩৭ হাজার কর্মীর মধ্যে সাত হাজার দুশো জন সিভিক ভলেন্টিয়ার রয়েছে। প্রথম থেকেই অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফোনে কথা বলেছেন নিহতের বাবা মায়ের সঙ্গে। এই ঘটনার প্রতিবাদের আর জি করের জুনিয়র ডাক্তার পড়ুয়ারা আন্দোলনে বসেছেন। নিজেদের সহকর্মীকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই নৃশংস খুনের ঘটনার পর এই প্রক্রিয়া অনিবার্য ছিল।
ঘটনার ব্যাপকতা অনুভব করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া হাতে মোকাবিলা করছিলেন।নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কলকাতা পুলিশ তদন্ত করতে ব্যর্থ হলে সিবিআইয়ের হাতে তদন্ত বার তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর পর পর কড়া পদক্ষেপে বিরোধী দল গুলি যে ভাবে প্রকা্শ্যে আন্দোলনে নামতে পারেনি।
কিন্তু ছাইচাপা আগুন দাবানলে পরিণত হল রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরের একটি সিদ্ধান্তে। জুনিয়র ডাক্তারদের নৃশংস হত্যাকান্ড বেআব্রু করে দিয়েছিলেন আরজি করের নিরাপত্তার চূড়ান্ত গাফিলতি। সেই দাবী সামনে রেখে আন্দোলনরত ছাত্রদের দাবী ছিল এই ঘটনার দায় নিয়ে হাসপাতেলের সুপার ও অধ্যক্ষকে সরিয়ে দিতে হবে। ডাক্তারদের দাবি মেনে আর জি করের সুপারকে বদলি করা হলেও অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে বদলি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে। অথচ এই অধ্যক্ষকের বিরুদ্ধে বহু দিন ধরে প্রতিহিংসার বহু অভিযোগ করেছিল ডাক্তাররা। এমনকি নিহত ডাক্তারকে নানা ভাবে মানসিক চাপ দেওয়াার অভিযোগ ছিল ডাক্তারদের। এই একটি ভূল সিদ্ধান্তই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে সমাজের একটা বড় অংশ।অন্যদিকে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ কলকাতা পুলিশের হাত থেকে মামলা সরিয়ে নিয়ে হাইকোর্টের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় একই সঙ্গে বিতর্কিত অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানো নির্দেশ দিয়েছে।
একজন কর্তব্যরত ডাক্তারকে নির্দয়ভাবে তাঁর কর্মস্থলে খুন হওয়ার ঘটনা বিচলিত করেছে নাগরিক সমাজকে বিশেষত নারীদের।বিশেষকরে গত কয়েক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীদের ওপর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রের্কড বুরোর তথ্য অনুসারে ভারতে প্রতিদিন ৮০ টির বেশি নারী ধর্ষণের ঘটনা সংগঠিত হয়। ২০২২ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম বুরোর রেকর্ড বলছে দেশের মধ্যে কলকাতা সবচেয়ে সুরক্ষিত শহর। কিন্তু আর জি করের ঘটনা প্রমাণ করছে কল্লোলিনী কলকাতা, সিটি অফ জয় কলকাতার সুরক্ষা আজ বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।
১৪ই আগষ্ঠ ফেসবুকে রিমঝিম সিংহের নারীদের রাতদখলের ডাকে সাড়া দেয় দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার নানান বয়সের মানুষ। কলকাতা থেকে কাকদ্বীপ শহর থেকে শহরতলীর সব প্রান্তে মধ্যরাতে রাজনীতির রঙহীন প্রতিবাদে পথে নেমেছে লাখ লাখ নারী পুরুষ। প্রতিবাদের নতুন চেহারার সাক্ষী থাকল দেশের জনগন। এই প্রতিবাদ আন্তজার্তিক সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হয়েছে।
অন্যদিকে এই স্বতস্ফুর্ত গণআন্দোলনের রাতে আর জি কর হাসপাতালে দুস্কতির ভয়ঙ্কর তান্ডবে জরুরী বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে আর জি করে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে গোটা রাজ্যের চিকিত্সা ব্যবস্থা চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছে। তার ফলে রাজ্যের সব হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ রয়েছে। জরুরী বিভাগ কোন রকমে চালাচ্ছেন সিনিয়র ডাক্তার। অধিকাংশ হাসপাতালে নতুন করে রোগী ভর্তি থেকে অস্ত্রোপচারের কাজ বন্ধ রয়েছে। সব মিলিয়ে লাথ লাখ গরিব রোগী দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। কলকাতার একটি প্রথম শ্রেণীর ইংরাজী দৈনিকের খবরে তুলে ধরে বলা হয়েছে চিকিত্সা না পেয়ে কলকাতার বিভিন্ন হাসাপাতালের বাইরে ও বিভিন্ন জায়গায় সব মিলিয়ে ৩৫ হাজার রোগী অসহায় ভাবে অপেক্ষা করছেন। সারা রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল গুলির প্রতিদিনের পরিষেবার দিকে এবার একটু নজর দেওয়া যাক পরিসংখ্যান বলছে রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালে সবমিলিয়ে আউটডোরে দৈনিক ২ লাখের বেশি রোগি ডাক্তার দেখাতে আসেন তাদের মধ্যে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে দৈনিক গড়ে ১২ হাজার রোগী ভর্তি করা হয়। এবার যদি আরজিকরের দিকে নজর দেওয়া যায় দেখা যাবে আর জি কর হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ১৬০০। আউটডোরে দৈনিক চিকিত্সার জন্য আসেন গড়ে ৩ হাজার ৬০০ জন। গড়ে দৈনিক ভর্তি করা হয় ২৪৫ জনকে।এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমান করা যায় গত এক সপ্তাহের বেশি সময় জুড়ে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি কত লাখ রোগীকে চূড়ান্ত অসহায়তার মুখে পড়তে হয়েছে। এদের মধ্যে কত জন অসহায় ভাবে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হয়েছে তার সঠিক হিসাব কারও কাছে জানা নেই।
প্রশ্ন এখানেই যে তিলত্তমা চিরকালের মতো মায়ের কোল খালি চলে গেছে তাঁর বাবা মায়ের যন্ত্রণা কোন ভাবে আমরা কমাতে পারব। তিলত্তমার হত্যায় জড়িতদের ফাঁসি আমরাও চাই। ডাক্তারদের নিরাপত্তা রাজ্য সরকারকে দিতেই হবে। তা না হলে নির্ভয়ে তাঁরা চিকিত্সা করবেন কিভাবে। তাঁদের এই নিরাপত্তাহীন সত্যিই চিন্তার। পাশাপাশি এবার সময় হয়েছে তিল তিল করে মৃত্যু দিকে এগিয়ে রোগিদের চিকিতেসার দিকেও। ডাক্তারি পেশাটা সমাজের আর পাঁচটা পেশার চেয়ে আলাদা। ডাক্তাররা আমাদের কাছে ভগবান। সেই ভগবানের প্রতি যে চরম অন্যায় করা হয়েছে তার বিচার যেমন চাই। ঠিক একই ভাবে অসহায় মানুষের চিকিত্সা থেকে যাতে বঞ্চিত না হউন সে বিষয়টিও এবার সুনিশ্চিত করার জন্য সমাজের সবার সরব হওয়ার এবার সময় হয়েছে। তার জন্য দরকারে আমরা আবার একবার মধ্যরাতে রাজপথে নামতেই পারি। কারণ চিকিত্সা পাওয়াটাও সব মানুষের অধিকারের মধ্যেই পড়ে।
মনিরুল হোসেন