লেখক- বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
কোনো কোনো সিনেমার সংলাপ মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। চলতি ভাষায় যাকে বলে ‘হিট’ সংলাপ। ওই সংলাপের নেপথ্যে যে চিত্রনাট্যকার বা সংলাপ রচয়িতা থাকেন তাকে মানুষ মনে রাখে না। সিনেমার পর্দায় যে অভিনেতা সেই সংলাপ আওড়ান তিনি মানুষের মনে গেঁথে থাকেন। তাই জনপ্রিয় অভিনেতা যখন রাজনীতিতে পা রাখেন তখনও মানুষের মনে এক মোহ জাল তাঁকে ঘিরে থাকে। এর উদাহরণ সবচেয়ে বেশি রয়েছে দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে। তবে বেশ কিছু বছর ধরে এই প্রবণতা হিন্দি বলয় ঘুরে আমাদের বঙ্গ রাজনীতিতেও পাকাপোক্ত হয়ে বসেছে।আমরা জানি রাজনীতি এবং অভিনয় দুটো জগতেই সংলাপ অত্যন্ত জরুরি। রাজনীতি তে জিনি তুখোড় বক্তা তিনি অন্য দের থেকে এগিয়ে থাকেন। তেমনি রূপোলী পর্দায় ‘হিট’ সংলাপ অভিনেতার জনপ্রিয়তা বাড়ায়।
তবে এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ ও অভিনেতার মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। অভিনেতা যে সংলাপ বলেন তা অন্য জনের তৈরি করে দেওয়া। এর জন্য ওই সংলাপের নৈতিক দায় তাঁর নেই। কিন্তু রাজনীতিবিদের তা নয়। তার মুখের কথায় প্রবল অশান্তি ছড়াতে পারে। হিংসা ছড়াতে পারে। তাই স্থান কাল পাত্র ভেদে কোথায় রাজনীতিক কোন কথাটা বলবেন তার নিরন্তর অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি। একজন অভিনেতা যখন রাজনীতিক হয়ে যান তখন অন্যের লেখা সংলাপ তাঁর মুখে আর থাকে না। যদিও তাঁকে নির্দিষ্ট দলের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলতে হয়। আর এখানেই সমস্যা তৈরি হয়। যেমন দেখা গেল কলকাতায় বিজেপির সদস্য পদ সংগ্ৰহের এক প্রচার সভায়। সেখানে নৈতিকতা সরিয়ে রেখে মিঠুন চক্রবর্তী যে ভাষায় কথা বললেন তাতে বোঝা গেল দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কী শুনতে চান তা তিনি ভালই রপ্ত করেছেন।
সেদিন প্রবীণ অভিনেতার সংলাপে যে উদগ্ৰ ঘৃনা র প্রকাশ ছিল তার লক্ষ্য সংখ্যালঘুরা। সবাই জানেন সারা দেশে এই ঘৃণা ছড়ানোর কাজ ই গেরুয়া শিবিরের নেতা মন্ত্রীদের প্রধান agenda। তবু আতঙ্ক এবং উদ্বেগ বাড়ে যখন একজন জনপ্রিয় অভিনেতা অতি অনায়াসে সেই ঘৃণার সংলাপ আওড়ান। ২০২৬ শে ‘মসনদ” জিততে তাঁর দল ‘যে কোনো কিছু” করতে প্রস্তুত এই উচ্চারণেই ছড়িয়ে পড়ে বিদ্বেষ। সেই সঙ্গে প্রবীণ অভিনেতা এটাও বুঝিয়ে দিলেন যে গেরুয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হল ধর্মীয় মেরুকরণ। আর এই মেরুকরণের প্রধান অস্ত্র ঘৃণা ভাষন । তাই এই অস্ত্র ত্যাগ করলে তো হাতে পেন্সিল ছাড়া আর কিছুই থাকে না। জনপ্রিয় অভিনেতার ঘৃণা ভাষনের পিছনে কারণটাও মনে রাখতে হবে। সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
কলকাতা সফরে এসে তিনি এক কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহে লক্ষ্য মাত্রা বেঁধে দিয়েছেন। সংবাদে প্রকাশ সেই লক্ষ্য মাত্রাকে সামনে রেখে সদস্য সংগ্রহ অভিযানে খুব একটা এগোতে পারে নি রাজ্য বিজেপি। এই কারণে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কড়া সমালোচনাও করেন । কলকাতায় যে সভা মঞ্চে প্রবীণ অভিনেতা বিষাক্ত সংলাপ বলেন সেটি ছিল এই সদস্য বৃদ্ধি অভিযানেরই অংশ। সেদিন সভা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। তার সামনে নিজেকে পারদর্শী প্রমাণ করার তাগিদ ছিল অভিনেতার। তাই বিদ্বেষ ছড়ানোর ও মেরুকরণের সহজ কৌশল ই তিনি বেছে নেন। বিদ্বেষের পথে চলা রাজনীতিকদের কাজে অন্য কিছু আশা করা বোকামি। তবু একজন শিল্পী মানবিক ও সংবেদনশীল হবেন এই আশাটুকু তো থেকেই যায়। তাই একজন জনপ্রিয় প্রবীণ শিল্পীর পদস্খলনে দুঃখ হয়। ঘৃণা ভাষনের কারণে প্রবীণ শিল্পীর বিরুদ্ধে এফ আই আর দায়ের হয়েছে। তবে তাতে যে তিনি সংযত হবেন তা ভাবাটা বোধহয় অর্থহীন।