লেখক- বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
এ বারের শীতকালীন অধিবেশনে বেনজির ঘটনার সাক্ষী থাকলো সংসদ। গত এক দশকে শাসক- বিরোধী সাংসদেরা অনেক বার ই পরস্পরের প্রতি আগ্ৰাসী মনোভাব দেখিয়েছেন। তবে বৃহস্পতিবার দুই পক্ষের সাংসদেরা যে ভাবে ধাক্কা ধাক্কি তে জড়িয়ে পড়েন তাতে প্রায় রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় সংসদ চত্বর। রক্তপাত ও ঘটে। সাম্প্রতিক অতীতে এমন ঘটনার নজির রয়েছে বলে মনে করতে পারেন নি বর্ষীয়ান সাংসদরা। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজ্য সভায় সংবিধানের পঁচাত্তর বছর নিয়ে বিতর্কের জবাবি বক্তব্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘এখন একটা ফ্যাশন হয়েছে, আম্বেদকর,আম্বেদকর, আম্বেদকর,আম্বেদকর। এতবার ভগবানের নাম নিলে সাত জন্ম ধরে স্বর্গ লাভ হতো’। এই মন্তব্য নিয়ে বুধবার থেকেই দিল্লির রাজনীতিতে তুলকালাম চলছে। শাহ’র মন্তব্যে দেশের সংবিধান প্রণেতা ও প্রথম আইন মন্ত্রীকে “অপমান” করা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার সংসদ চত্বরে ধর্নায় বসে কংগ্রেস সহ বিরোধীরা। কিছু টা মকর দ্বারে বিজেপি সাংসদ রা। সেই সময় মকর দ্বার দিয়ে বিরোধীরা সংসদে ঢোকার চেষ্টা করলে ধুন্ধুমার বাধে। বিজেপির এই সক্রিয়তার একটাই কারণ। বিরোধী রা ‘দলিত icon’ আম্বেদকর কে অপমান করার অভিযোগ তোলায় দলিত ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে চিন্তায় পড়েছে শাসক দল। লোকসভা নির্বাচনের সময় “মোদী সরকার চারশো আসন পার করে সংবিধান বদলাতে চাইছে”, বলে লাভের ফসল ঘরে তুলেছে বিরোধীরা। তাই আগামী বছর দিল্লি ও বিহারের ভোটে এই নিয়ে বিরোধী প্রচারে বিপদ দেখছে বিজেপি। ২০১৫ সালে বিহার নির্বাচনের মুখে নিম্ন বর্গের সংরক্ষণ নিয়ে ভেবে দেখার কথা বলেছিলেন RSS প্রধান মোহন ভাগবত। নির্বাচনে তার খেসারত দিতে হয়েছিল গেরুয়া শিবিরকে। শুধু যে উচ্চবর্ণের ভোট নিয়ে ক্ষমতার সব পরিসর দখল করা যাবে না, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তা বুঝেছে RSS তথা বিজেপি। হিন্দুত্বের রথে নিম্ন বর্ণের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে তুলতে পারলে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে বলে বুঝেছে RSS। তাই ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে ভারতের গণতন্ত্র এবং সংবিধানে আম্বেদকরের অবদান নিয়ে ভুয়সী প্রশংসা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বিজেপির এই কৌশল বদলের ফলে গত এক দশকে দলিত আদিবাসী এবং ওবিসির একটি বড় অংশের ভোট পেয়েছে তারা। আম্বেদকর ও দলিত, আদিবাসী এবং ওবিসি সম্পর্কে RSS এর দীর্ঘদিনের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলানোর ফল হলো এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক কৌশল। ১৯৩৫ সালের দলিত মাহার সম্প্রদায়ের এক সভায় হিন্দু ধর্মের জাতপাত ও অস্পৃশ্যতার কারণে ধর্ম পরিবর্তন করার আভাস দেন আম্বেদকর। আম্বেদকরের হিন্দু ধর্মের এই সমালোচনায় ১৯৩৬ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন আর্য সমাজ ও হিন্দু মহাসভার সভায় “Annihilation of Caste” নিয়ে আম্বেদকরের বক্তৃতা বাতিল করা হয়। ১৯৫১ সালে আম্বেদকরের Scheduled Castes Federation এর ইস্তাহারে হিন্দু মহাসভা এবং RSS কে ” প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি” বলে উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার পরে দেশের আইন মন্ত্রী হিসাবে Hindu Personal Law কে সংস্কার করতে Hindu Code Bill আনতে চান আম্বেদকর। সেই সময় RSS এর মুখপত্র Organiser এ ধারাবাহিক ভাবে ওই বিলকে তীব্র আক্রমণ করা হয়। সংসদে এই বিল পেশ করতে না পেরে ১৯৫১ সালে নেহরু মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন আম্বেদকর। জাত পাত ও অস্পৃশ্যতায় ব্যথিত এবং হতাশ হয়ে ১৯৫৬ সালে প্রায় পাঁচ লক্ষ দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ কে সঙ্গে নিয়ে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰহণ করেন আম্বেদকর। এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে RSS. এরপরে ১৯৮১ সালে তামিল নাড়ুর তিরুনেলভেলিতে কয়েক শত নিম্ন বর্ণের হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই প্রবণতা দেখে হিন্দুত্ব নিয়ে আম্বেদকরের প্রতি কী দৃষ্টি ভঙ্গি হবে তা ঠিক করতে RSS এর সর্বোচ্চ কমিটি অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা আলোচনা শুরু করে। সেই আলোচনার ফল হল দৃষ্টিকোণ বদলে ১৯৮৩ সালের ১৪ই এপ্রিল মহারাষ্ট্রে আম্বেদকরের জন্মদিন পালন করে RSS। ১৯৯০ সালে আম্বেদকরের জন্মশতবর্ষ ও পালন করে সংঘ। এই প্রেক্ষাপটে সরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে যথেষ্ট ই বিপাকে পড়েছে গেরুয়া শিবির। কারণ সবকিছুর উপরে ভোট বড় বালাই।