লেখক-বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য

জীর্ণ, পুরাতন বছর যখন ক্লান্ত শরীর নিয়ে নতুন কে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য ছায়া গোড়ায় তখনই পত্র পত্রিকা থেকে সমাজ মাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হয়। গ্ৰহ , তারা, নক্ষত্রের অবস্থান দেখে কুষ্টি ঠিকুজির বিচার শুরু হয় নানান কাল্পনিক ভবিষ্যৎ বাণী। না, টিকি, দাড়ি, তিলক নিয়ে আমি সেই পথে নামিনি। ২০২৫ সালে রাজনীতির উঠোন কেমন থাকবে আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। অস্তাচলের দিকে পা বাড়ানো বছরে রাজনীতির চলন দেখেই উত্তর খুজবো। ২০২৪ সালে নির্বাচনের সুনামি দেখেছে বিশ্ব । বসুন্ধরার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক দাঁড়িয়েছিল ভোটের লাইনে। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশে মানুষ পছন্দ মতো সরকার বেছে নিয়েছেন। ভারতের মতো, ব্রিটেন ও আমেরিকাতে রাজনৈতিক পন্ডিতদের ভবিষ্যৎ বাণী উড়িয়ে চমক দিয়েছে জনতা। আবার ফ্রান্স, জর্মনি, দক্ষিণ কোরিয়াতে ভোট নয় সংসদের সঙ্গে সরকারের মতবিরোধে শাসকের গদি টলোমলো। অন্যদিকে, জনতার ক্ষোভ, ক্রোধ, অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ ও সিরিয়ায় দোর্দন্ড প্রতাপ শাসককে দেশ ছাড়া করেছে আড়ালে থাকা কুশীলব রাত। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় অবশ্য অনু্রা কুমারা দিশানায়েকের জয় প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল। যেমন পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট যে আরও গভীর হবে তাও প্রত্যাশিত। ২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে অনেকেই ভেবেছিলেন নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরা। সময়ের অপেক্ষা। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণে সেই জয়ের আলপনা আঁকা শুরু হয়।

শেয়ার বাজারের তেজি ভাব ও সেই জয়ের ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু আসল তাস ভোটার দের আস্তিনে লুকানো ছিল। রামমন্দিরের রাজ্য উত্তর প্রদেশেই ভোটের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেল বিজেপি। গতবারের তুলনায় ৬৩টি আসন কম পেয়ে তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফিরলেন মোদী। প্রায় পঁচিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথম মিলি জুলি সরকারের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে মোদী কে। রাজনৈতিক সম্পর্ক২০২৪ ছিল নির্বাচনী বছর। নির্বাচন পেরিয়ে কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যে নতুন সরকার। আশা করা যায় গনতান্ত্রিক রীতি মেনে কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকার গুলি সুশাসনে মন দেবে। এই কাজে বিরোধীদের ও ভূমিকা থাকা উচিত। কিন্তু দুই জাতীয় দল বিজেপি ও কংগ্রেসের সংসদের বাইরে ও ভিতরে পারস্পরিক সম্পর্কে যে তিক্ততা দেখা গিয়েছে তা আরও বাড়ার সম্ভাবনা ই দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গনতন্ত্রের দাবি মেনে দুই দলের মধ্যে আলাপ আলোচনার পরিসর তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিরোধীরা সংসদে অনাস্থা প্রকাশ করে উপরাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেছে। সংসদ চত্বরে শাসক- বিরোধীদের ধস্তাধস্তিতে রক্ত ঝরেছে। সংসদে বিরোধী দল নেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে FIR হয়েছে।

মন্দির – মসজিদ বিবাদহিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ হয়েছে এই দাবিতে বিবাদ রামমন্দির নির্মাণের পরে থেমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু থামেনি। শুধু উত্তর প্রদেশেই এই বিবাদে প্রায় পঞ্চাশ টি মামলা চলছে আদালতে। আপাতত নিম্ন আদালতে চলা সব মামলায় রাশ টেনেছে সুপ্রিম কোর্ট। RSS প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, হিন্দু আবেগের পরিনতি রাম মন্দির নির্মাণ। তারপরে সব মসজিদে হিন্দু মন্দির খুঁজতে যাওয়া অভিপ্রেত নয়।

বহু সাধু সন্ত সঙ্ঘ প্রধানের এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। সমাজ মাধ্যমে ও ছড়িয়েছে বিরোধীতা। খোদ সঙ্ঘের মুখপত্র অরগ্যনাইজারের সর্বশেষ সংস্করণে ভাগবতের বক্তব্যের উল্টো সুর শোনা গিয়েছে। ফলে ২০২৫ সালে মন্দির মসজিদ রাজনীতি তে দাঁড়ি টানার সম্ভাবনা কম। দুই নির্বাচনএকেবারে নির্বাচন শুন্য যাবে না ২০২৫। নতুন বছরের প্রথম ভাগে দিল্লি ও শেষের দিকে রাজনীতির ট্র্যপিজে নিপুণ শিল্পী নীতীশ কুমার কি আবার সেই দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারবেন? বা ২০১৩ থেকে দিল্লিতে ক্ষমতাসীন দূর্নীতির কলঙ্ক মাথায় নিয়ে বিদায় নেবেন? দুটি প্রশ্নের ই উত্তর পাওয়া যাবে ওই নির্বাচনে। পাশাপাশি ২০১৪ সাল থেকে দিল্লির সাতটি লোকসভা আসনের সাতটি তেই জিতেছে বিজেপি। কিন্তু রাজ্যের ভোটে মোদী যাদু কাজ করেনি। এবারে দিল্লির ভোটে নরেন্দ্র মোদী কি ছবি টা পাল্টাতে পারবেন? সেই প্রশ্ন ও থাকবে। সংসদে উত্তাপনতুন বছরে এক দেশ, এক ভোট আর ওয়াকফ সম্পত্তি বিল নিয়ে সংসদ যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। প্রথম বিলটি পাস করানোর জন্য পঞ্চাশ শতাংশের বেশি সাংসদের সমর্থন ও ভোটাভুটির সময় উপস্থিত সাংসদ দের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন। সংসদের দুই কক্ষেই বিজেপির এই সংখ্যা নেই। গত দশ বছরে প্রয়োজনীয় সংখ্যা না থাকলে ও কাশ্মীরে ৩৭১ ধারার অবলুপ্তি সহ অনেক বিল ই কৌশলে পাস করিয়েছে বিজেপি। তবে এক দেশ এক ভোটের বিরুদ্ধে এককাট্টা সব বিরোধী দল। তাই সংসদে উত্তাপ ছড়ানোর সব মশলা ই মজুত থাকবে। জনগণনার, জাতি গণনাদীর্ঘ সময়ে ঠান্ডা ঘরে রাখার পরে অবশেষে ২০২৫ সালে দেশে জনগণনার কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে বিজেপি সরকার। বিরোধী দের দাবি সেই সঙ্গে জাতি গণনার কাজ ও শুরু করতে হবে। বিরোধী রা মনে করছে জাতি গণনা দিয়ে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির মোকাবিলা করা যাবে। এই দ্বন্দের অনুমান করেই মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে ” এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়” স্লোগান তুলেছিল বিজেপি। শাসক বিরোধী সংঘাতে হাতিয়ার হয়েছেন সংবিধান প্রণেতা বাবা সাহেব আম্বেদকর। সব মিলিয়ে নতুন বছরে রাজনীতির উঠোনে স্ফুলিঙ্গ যথেষ্ট পরিমাণেই দেখা যেতে পারে।
