লেখক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
প্রায় আড়াই দশক আগের কথা। সিটুর কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন । সাংবাদিকদের মধ্যে আমরা যারা বামপন্থী দল বা সংগঠন গুলো কভার করতাম তাদের কাছে তিনি শিবানী দি বলেই পরিচিত ছিলেন। গৌরবর্ণা মিষ্টভাষী, মুখে সর্বদা স্মিত হাসি – শিবানী দিল সেই আদলটা এখনো মনে আছে। সিটুর সভায় মঞ্চে তাঁর ঠাঁই হলেও দু- একবার ছাড়া তাঁকে কখনও বক্তাদের তালিকায় ঠাঁই পেতে দেখিনি। তবে, কোনো কর্মসূচিতে যদি নির্মিত বেদীতে নেতারা ফুল দিতেন অনুষ্ঠান শুরুর আগে তখন দেখতাম নেতাদের হাতে ফুল মালা এগিয়ে দেওয়ার ভার দেওয়া হতো শিবানী দি কে। প্রায় ৩৫ বছর সাংবাদিকতার পেশায় থাকার কারণে বছরের পর বছর সিপিএমের পার্টি চিঠিতে দেখেছি দলীয় সংগঠনে বা শাখা সংগঠনে মহিলাদের সংখ্যা বাড়ানো এবং মহিলাদের প্রথম সারিতে তুলে আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে পলিটব্যুরো তে এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে হাতে গোনা কয়েকজন মহিলার উপস্থিতি দেখেছি। রাজ্য কমিটি বা রাজ্য সম্পাদক মন্ডলীতেও তাই। এই সময় কালের মধ্যে সিপিএমের সবচেয়ে পরিচিত এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মঞ্চে এবং সংসদে বা ছাপা অথবা দৃশ্য মাধ্যমে যে সিপিএম নেত্রীর নাম প্রথমেই স্মরণে আসে তিনি বৃন্দা কারাত। অথচ এর বাইরে বৃন্দার যে তুমুল সংগ্ৰামী অতীত রয়েছে তা আর কজন জানেন। তবে পার্টির পত্র পত্রিকা এবং পার্টি প্রকাশিত গ্ৰন্থে স্মরণীয় নেতাদের প্রতিস্পর্ধী ও সংগঠিত আন্দোলনে উজ্জ্বল ভূমিকার কথা ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এই পরিসরে বৃন্দার ও যে অতি অনমনীয় ভূমিকা রয়েছে তা নিয়ে দলীয় স্তরে কোনো লেখা চোখে পড়ে নি। কিন্তু, প্রয়াত এক সিটু নেতার কাছে শুনেছি বৃন্দার রাজনৈতিক জীবনের প্রত্যুষে দিল্লিতে শ্রমিক আন্দোলনের আঁচে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠার কথা। শ্রমিক মহল্লায়, কারখানায় হার না মানা সাহসী কর্মী হিসেবে বৃন্দার দিন যাপনের অনেক কথাই তাঁর মুখে শুনেছি। ওই প্রয়াত নেতার কাছে ই শুনেছিলাম দিল্লির কোনো এক কারখানায় শ্রমিকদের আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে তরুণী কর্মী বৃন্দা ও সঙ্গী ছিলেন সেই সময় ই একদিন মালিক পক্ষের গুন্ডারা কারখানা ঘিরে ফেলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বৃন্দা কে হেনস্থা করা। শেষ পর্যন্ত অনেক রাতে অন্য জায়গা থেকে শ্রমিক রা জড়ো হয়ে বৃন্দা কে কারখানা থেকে বাইরে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিনের পরেও কিন্তু বৃন্দা একই ভাবে শ্রমিক সংগঠনের কর্মী হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই আবহে সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক পদে দেবলীনা হেমব্রমের মনোনয়ন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৬৪ সালে দলের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দলের জেলা কমিটির সম্পাদক পদে কোনো মহিলার ঠাঁই হয়নি। দেবলীনা ই প্রথম। জনজাতি সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দেবলীনার ও দীর্ঘ ও সংগ্ৰামী জীবন রয়েছে। লিঙ্গ বৈষম্যের কাঁচের দেওয়াল ভেঙে দেবলীনার এই অধিষ্ঠান বাংলার জনজীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আশা করি মেয়েদের ভোট টানার মুদির হিসেব নয় দেরিতে হলেও মহিলাদের ক্ষেত্রে দলের প্রগতিশীল মানসিকতা থেকেই দেবলীনা কে নেতৃত্বে তুলে আনা হল।
