লেখক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি, ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে, শেখ মুজিবের বাড়ি।১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে এই ছড়া বেঁধেছিল মুজিবের দল। এই ছড়া শ্লোগান হয়ে গ্ৰাম – শহরের পথে, মাঠে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ছড়া -শ্লোগানের স্মৃতি হয়তো সাতের দশকে যারা কৈশোর যৌবনের সীমারেখায় ছিলেন তাঁদের মনে আছে। কিন্তু, ছড়ায় ধানমন্ডি তে মুজিবের যে বাড়ির কথা রয়েছে তা মুছে গেল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম রূপকারের বাড়ি গত বুধবার রাতে ক্রেন, ড্রিল ও ভ্যাকুম মেশিন দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে ‘ছাত্র- জনতার’ মোড়কে ‘নারা-এ-তকবির’ শ্লোগান দেওয়া কয়েক হাজার তরুণ। ছ ‘মাস আগে গতবছরের ৫ই অগাস্ট সন্ধ্যায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঢাকায় ৩২ নম্বর ধানমন্ডি রোডে শেখ মুজিবুর রহমানের এই বসত বাড়িটি।
আগুনের গ্ৰাসের চিহ্ন নিয়ে টিঁকে ছিল কংক্রিটের কাঠামো টুকু। সে চিহ্ন ও ধুলিসাৎ হয়ে গেল। সামাজিক মাধ্যমে ফলাও করে জানিয়েই এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। তাই দিনক্ষণ সবই সবার জানা ছিল। অথচ গোটা দেশ যখন এই ধ্বংসযজ্ঞের সরাসরি সম্প্রচার দেখছিল তখন ইউনুস সরকারের কোনো মন্ত্রী -সান্ত্রীরা সেনা প্রধান ওয়াকার -উজ-জামানের কোনো সেনা জওয়ানকে ধানমন্ডির ত্রিসীমানায় দেখা যায় নি। এই ধ্বংস লীলায় বাধা দেওয়া তো দূরের কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের অনেক ধুলিকণা মিশে ছিল ওই বাড়ির ভিতর-বাহিরে। এই বাড়ি থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক দিয়েছিলেন মুজিব। বুলডোজারের মূঢ় শক্তির অভিযান যখন ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে শেষের পথে তখন একদল উন্মত্ত জনতা ওই রাস্তার ৫ নম্বর ‘সূধাসদন’ বাড়িটিতে ও আগুন লাগিয়ে দেয়।
স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার ওই বাড়িটিতে একসময় হাসিনা থাকতেন। ১৯৬০ এর শেষ দিক থেকে মুজিব কে ভালবেসে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলেই সম্বোধন করা শুরু হয় বাংলাদেশে। ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির এই বাড়িতে ১৫ অগাস্ট রাতে যখন মুজিব কে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন দেশের এই বন্ধুর পাশে কোনো বন্ধু কে দেখা যায় নি। আর আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ঘোর শত্রু পুরীতে সম্পুর্ন নির্বান্ধব পরিবেশে ধুলিসাৎ হয়ে গেল কত আনন্দ বেদনার সাক্ষী থাকা বসত বাড়িটি।
সাতের দশকে ইতিহাস গায়ে জড়ানো বাংলাদেশ কে আজ যারা মুছে দিতে চাইছেন তাদের আর যাই থাক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা একেবারেই শূন্য। সামান্য ধারণা থাকলেও তাঁরা জানতেন যেদিন থেকে পৃথিবী নামক ভূখণ্ডে ক্ষমতা শালী বা ক্ষমতাধরদের আবির্ভাব হয়েছে সেদিন থেকেই ক্ষমতার দম্ভ ইতিহাস মোছার চেষ্টা করেছে। ক্ষমতাকে ভোঁতা করে ইতিহাস জলে -স্থলে – অন্তরীক্ষে কোনো না কোনোভাবে সজীব থেকেছে। অন্ধকার শক্তি নিজেকে যতই বড় ভাবুক না কেন ‘আসলে কেউ বড়ো হয় না বড়োর মতো দেখায়’ । এখানেই থামেন নি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তাঁর অমোঘ বিধান প্রকৃতি -মানুষের যে গণনাতীত দৈর্ঘ তার ‘সামনে গিয়ে দাড়াও , দেখবে কত ছোট ‘।