লেখক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
‘Ten Commandments’ ১৯৫৬ সালে হলিউডে নির্মিত বিখ্যাত সিনেমা। মহাকাব্যিক ক্যানভাসে বিস্তৃত এই সিনেমায় ফ্যারাও শাসিত মিশরে ইহুদিদের অবর্ণনীয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাসভূমির খোঁজে কঠিন যাত্রার বর্ণনা রয়েছে। শুরুতে এই সিনেমার কথা বলছি কারন করোনা অতিমারির সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের বৌ-বাচ্ছার হাত ধরে বিজন বিভুঁই থেকে ঘরপানে ফেরার আকুল চেষ্টার দৃশ্য যদি মনে পড়ে যায়। তবে, Ten Commandments এর দিশেহারা ইহুদি সম্প্রদায়ের পথ নির্দেশক হিসেবে মহাকাব্যিক চরিত্র মোজেস ছিলেন। লকডাউনের ঘেরাটোপে যানবাহন হীন অনন্ত পথ চলায় গরীব গুর্বো পথশ্রমে হা-ক্লান্ত মানুষগুলোর সামনে কেউ ছিল না। এই নিষ্ঠুর দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে জানা গিয়েছিল কোন রাজ্য থেকে কোন রাজ্যে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক আসা যাওয়া করেন বা কোথায় কি অবস্থায় থাকেন তার নির্দিষ্ট কোনো তথ্য রাজ্য সরকার গুলি বা কেন্দ্রীয় সরকার কারুর কাছেই নেই। এই পরিস্থিতিতে দেশের শীর্ষ আদালত কেন্দ্রীয় সরকার কে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য জাতীয় তথ্য পঞ্জী তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিল। অবশেষে ২০২১ সালে এই লক্ষ্যে ই-শ্রম পোর্টাল চালুর কথা ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক। যদিও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য এই ধরনের নির্দেশিকা ওটাই প্রথম নয়। ১৯৭৯ সালে interstate migrant workmen act লাগু করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সেই আইনে বলা হয়েছিল প্রতিটি ঠিকাদারি সংস্থাকে নির্দিষ্ট কতৃপক্ষের থেকে License নিতে হবে। পাশাপাশি, ঠিকাদার সংস্থা গুলি কে প্রতিটি পরিযায়ী শ্রমিক সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। ২০০৭ সালে National Commission for Enterprises বলেছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সর্বজনীন নথিভুক্তিকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ২০০৮ সালে The unorganised workers social security act এ নথিভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য পরিচয় পত্র দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আইন বা সুপারিশ গুলি দিন কাল পেরিয়ে সরকারি দফতরের বাইরে আসেনি। তাই অতিমারির মতো বিপর্যয়ের সময় পরিযায়ী শ্রমিকরা দৃশ্যমান হলেও ফের তারা সামাজিক পরিসরে অদৃশ্য জনগোষ্ঠী। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক জানিয়েছে যে “ই- শ্রম পোর্টালে ৩০০ মিলিয়ন পরিযায়ী শ্রমিকের নাম নথিভুক্ত হয়েছে। ই-শ্রম পোর্টাল বর্তমানে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য বৃহত্তম পোর্টাল”। কিন্তু, এখনো পর্যন্ত ই-শ্রম পোর্টাল শুধুমাত্র পরিযায়ী ও অসংগঠিত শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তিকরণের ব্যবস্থা হিসেবেই থেকে গিয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয় পরিযায়ী শ্রমিকদের। এক জায়গা থেকে এক জায়গায় কাজের খোঁজে ঘোরা মানুষ গুলো ভোটার তালিকার বাইরেই থেকে যান। পাশাপাশি প্রায়শই লাঞ্ছনা, পাচার হয়ে যাওয়া, শ্রমিক সংগঠনের উপেক্ষা, নাগরিক অধিকার হীনতার শিকার হতে হয়। ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সবচেয়ে অবহেলিত অংশ এই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা অত্যন্ত আবশ্যিক। অথচ, ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচার করলেও পরিযায়ী শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে ই- শ্রম পোর্টাল আশ্চর্য ভাবে নীরব ।