নজরুলগীতির বিকৃতিতে আদৌ অনুতপ্ত ওঁরা?

ক্ষমা চেয়ে গোলমেলে বিবৃতি

প্রবল গণপ্রতিবাদ। এবং চাপে পড়ে অবশেষে ক্ষমা চাইলেন ‘পিপ্পা’ (Pippa) চলচ্চিত্রের প্রযোজক (producer), পরিচালক (director) ও মিউজিক কম্পোজার (music composer)। ‘Roy Kapur Films’ অ্যাকাউন্ট থেকে এক্স (X, পূর্বনাম Twitter) হ্যান্ডলে প্রকাশ করা হয়েছে ‘পিপ্পা’ টিমের বিবৃতি। ইংরেজিতে লেখা সেই বিবৃতির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়—

“কারার ঐ লোহ কপাট’ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কে ‘পিপ্পা’ ফিল্মের প্রযোজক, পরিচালক ও মিউজিক কম্পোজারের ব্যাখ্যা এই যে, গান পরিবেশনে আমরা শৈল্পিক উপস্থাপনার প্রতি আন্তরিক থেকেছি। প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের স্বত্ব থেকে রূপান্তরের অধিকার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিশ্চিত করার পরই কাজ শুরু করি আমরা।”

“গানটির মূল সাংগীতিক কাঠামোর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সাংগীতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অপরিসীম। তাঁর প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে এই অ্যালবাম তৈরি হয়েছে। মুক্তি, শান্তি ও সুবিচারের লড়াই ঘিরে মানুষের যে ভাবাবেগ, তা মাথায় রেখেই করা হয়েছে অ্যালবামের কাজ।”

“কাজী অনির্বাণের উপস্থিতিতে গানের কথা সম্পর্কিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন কল্যাণী কাজী। বর্তমানে তিনি প্রয়াত। অনুমোদনের সেই চুক্তি ও তৎসম্পর্কিত চিঠির প্রতি বিশ্বস্ত থেকে কাজ করেছি আমরা।”

“নতুন সাংগীতিক কাঠামোয় গানের কথা ব্যবহারের অনুমতি ছিল চুক্তিতে। ওই চুক্তিতে স্থির হওয়া শর্তে আমরা আবদ্ধ হয়েছিলাম গানটির সংস্কৃতিক তাৎপর্যের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানোর অভিপ্রায়ে।”

“গানের মূল সাংগীতিক কাঠামোর প্রতি শ্রোতাদের আবেগ আমরা বুঝতে পারি। সমস্ত শিল্পই অন্তর্গতভাবে ব্যক্তিগত অনুভব-সাপেক্ষ। তাই আমাদের উপস্থাপনা যদি কারও ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে থাকে অথবা তা কারও বেদনার অনিচ্ছাকৃত কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমরা আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি।”

“পিপ্পা’ টিম”-এর বিবৃতির বাংলা তর্জমায় আমরা ইংরেজি ‘composition’-এর অনুবাদ করেছি— সাংগীতিক কাঠামো। সংগীতের ক্ষেত্রে ‘composition’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ বহু বিস্তৃত। গানের কথা, সুর, স্বর, তান, লয়, তাল, যন্ত্রানুষঙ্গ প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই composition-এর গতিবিধি অবাধ। তবে প্রচলিত ব্যবহারিক অর্থে শব্দটির মাধ্যমে প্রধানত যন্ত্রানুষঙ্গ বা musical instrumentation বোঝানো হয়। যদি তাই হয়, তাহলে এই বিবৃতিতে সুনির্দিষ্টভাবে সুর (tune) এবং স্বরলিপি (notation) নিয়ে চুক্তির কথা উল্লেখ করা হল না কেন? অথচ, ‘কাজী অনির্বাণের উপস্থিতিতে কল্যাণী কাজীর স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র’ অনুসারে নতুন কম্পোজিশনে গানের কথা (lyric) ব্যবহারের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। ভুলভাল স্ক্যানিং সত্ত্বেও তা যে অবিকৃত রয়েছে এআর রহমানের পরিচালনায়, সৌভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনপূর্বক এ আমাদের মানতে হবে। কিন্তু বিতর্ক তো বেধেছে সুর (tune) তথা স্বরলিপি (notation) নিয়ে! ‘composition’ শব্দের আড়ালে নজরুলগীতিটির সেই আদি সুরের শর্ত বিষয়ে অস্বচ্ছতা রাখার কারণ কী? মূল আপত্তি তো সেখানেই। বিকৃতিও সেখানে।

কাজী নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারী এবং কল্যাণী কাজী-স্বাক্ষরিত চুক্তির একমাত্র সাক্ষী, কাজী অনির্বাণ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নতুন কম্পোজিশনে কথা ও সুর অবিকৃত রাখার চুক্তি করা হয়েছিল। এমনকি, এআর রহমানকৃত নতুন কম্পোজিশন শুনিয়ে নেওয়ার শর্তও আরোপিত হয়েছিল। বহু বিলম্বে, কল্যাণী কাজীর প্রয়াণের পর, এখন এই প্রকাশিত অ্যালবামে সে’সব শর্ত পূরণ হল কই? সুরের শর্ত তো বটেই, ক্ষমাপ্রার্থনার বিবৃতিতে ‘শুনিয়ে নেওয়ার শর্ত’ও উহ্য বা অনুপস্থিত! কেন? তাহলে কি আমরা বুঝে নেব, ‘আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থনা’র মাধ্যমে গণ অসন্তোষকে প্রশমিত করাই “পিপ্পা’ টিম”-এর একমাত্র উদ্দেশ্য নয়—পাশাপাশি, চুক্তিপত্রের আইনি দিকটি ধামাচাপা দেওয়াও অন্যতম মতলব? নাকি কোথাও ভুল হচ্ছে কাজী অনির্বাণেরই!

চুক্তিপত্র সামনে না এলে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। কিন্তু এখনই নিশ্চিতভাবে যে’প্রশ্ন তোলা যায়, তা হল— কাজী অনির্বাণের দাবি যথেষ্ট স্পষ্ট হওয়া সত্বেও রাজা মেননদের বিবৃতিতে এত অস্পষ্টতা কেন?

‘পিপ্পা’ কি আমাদের ‘ধাপ্পা’ দিতে চাইছে?